
একজন নারী প্রতিদিন প্রায় ৮ ঘন্টা ঘরের সেবামূলক কাজে ব্যয় করেন, যার পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্যায়ন নেই। যেকারণে নারীরা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়ছেন। এমন বাস্তবতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন, নারীর ঘরের কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন খুবই দরকার। তার সরকার পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেবে।
শনিবার ঢাকার দৃক গ্যালারিতে অমূল্যায়িত সেবামূলক কাজের উপর একশন এইড বাংলাদেশের একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ ও আলোচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী।
‘ভিন্ন রূপে পুরুষ’ নামের এই অনুষ্ঠানে ‘গৃহস্থালি কাজে নারী ও পুরুষের সময়ের ব্যবহার’ বিষয়ে গবেষণা প্রতিবেদনটি তুলে ধরে একশনএইড বাংলাদেশ। গবেষণার ফলাফল বলছে, একজন নারী প্রতিদিন প্রায় ৮ ঘন্টা গৃহস্থালির সেবামূলক কাজে ব্যয় করেন। যেখানে পুরুষের ব্যয় হয় দেড় ঘন্টা। নারীরা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তার কাজের দাম পান না। সেই সাথে নারীকে দ্বিগুণ বোঝা’ টানতে হচ্ছে। বয়স্ক নারীদের আরো কঠিন পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে যেতে হচ্ছে।
একশনএইড বাংলাদেশের পাওয়ার প্রজেক্ট-এর আওতায় লালমনিরহাট এবং গাইবান্ধা জেলার তৃণমূল নারী এবং পুরুষের বিভিন্ন কাজে সময়ের ব্যবহার নিয়ে ২০১৬ সালের শেষের দিকে করা গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল, বিভিন্ন সেবামূলক কাজে নারী ও পুরুষের সময় ব্যবহারের পরিমাণ নির্ণয় করে জেন্ডার ভূমিকা সম্পর্কে জানা ও পরিবর্তন আনা। লালমনিরহাট ও গাইবান্ধা জেলার ১০টি ইউনিয়নে গবেষণাটি পরিচালিত হয়, যেখানে ৬০০ জন ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন।
গবেষণা প্রতিবেদনটি তুলে ধরে প্রধান গবেষক মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, “সার্বিকভাবে নারীরাই বেশি কাজ করছে। গবেষণায় দেখা যায় সেবামূলক কাজে পুরুষরা খুব আগ্রহী নয়। তাদের মতে এগুলো মেয়েদের কাজ। পুরুষরা বলেছেন, ঘরের কাজে নারীদের সাহায্য করা দরকার তবে তা পারিবারিক দায়িত্ব নয়। তাই মেয়েদের ঘরের কাজে শুধু সাহায্য নয় এটা পারিবারিক দায়িত্বের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।”
গবেষণার ফলাফল বলছে, গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে আয়মূলক কাজে নারীর সংযুক্ত হওয়া যা তাদের আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তবে প্রচলিত সামাজিক ধ্যান-ধারণার কারণে নারী এখনো নির্যাতনের শিকার।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেন, “আমাদের দেশে অমূল্যায়িত সেবামূলক কাজের মূল্যায়ন নেই। যার কারণে জিডিপিতে এর অন্তভূর্ক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করাটা খুব জরুরি।”
তিন আরো বলেন, “অমূল্যায়িত কাজ হিসেবের মধ্যে আনার পদ্ধতিটা এখনো নেই। এটা যোগ করাটা জরুরি। বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব। এবং সরকারিভাবে আমরা এটাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাবো। ”
নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাছিমা বেগম বলেন, “নারীরা যে পরিমাণ গৃহস্থালীর কাজ করে তা আমরা মূল্যায়ন করি না। গ্রামে সাধারণত নারীরা বিয়ে করা মানে ঘরের সব কাজের দায়িত্ব নেয়া। কিন্তু সেখানে বিন্দুমাত্র সম্মান দেয়া হয় না। নারীরা ঘরের কাজের জন্য মূল্য চায় না, চায় শুধু সম্মান। তাই আমাদের পারস্পরিক সম্মানবোধটুকু বাড়াতে হবে।”

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, “আমাদের পরিবারের অনেক পুরুষ সদস্যরা মেয়েদের ঘরের কাজকে কাজ হিসেবে বিবেচনা করেন না। যেটি নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে বাধা তৈরি করছে। নারীর উন্নয়নে প্রত্যেকটা পরিবারকে ভাবতে হবে। সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতি সহযোগিতা নিয়ে। নারীর সহযোগিতা এবং ভূমিকা না থাকলে সমাজ ও দেশ উন্নত হত না। তাই সব উন্নয়ন পরিকল্পণায় নারীকে সম্পৃক্ত করতে হবে’।
গবেষণা বলছে, অমূল্যায়িত সেবামূলক গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি, হ্রাস ও পুনর্বণ্টন- এই তিন ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসলে নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি হবে। এক্ষত্রে পুরুষের ভূমিকা বেশি। একশনএইড বাংলাদেশ তাই গৃহস্থালির সেবামূলক কাজ নিয়ে ‘ভিন্ন রূপে পুরুষ’ শীর্ষক জাতীয় পর্যায়ে আলোকচিত্র প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। বিজয়ীদের ছবি নিয়ে ঢাকার দৃক গ্যালারিতে ৫ দিনের আলোচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করছে। শনিবার এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিজয়ীদের হাতে পুরষ্কার তুলে দেন অর্থমন্ত্রী ও আমন্ত্রিত অতিথিরা।
সারাদেশ থেকে আলোচিত্রীরা পুরুষের রান্না করা, সন্তানের লালন পালন ও লেখাপড়ার দেখভাল, ঘরের কাজ যেমন-থালাবাসন ধোয়া. কাপড় ধোয়া, ঘর-উঠান পরিষ্কার করা, জ্বালানি/লাকড়ি সংগ্রহ করা, পানি আনা (শুধু রান্না ও ধোয়া-মোছার কাজের জন্য), পরিবারের সদস্যদের বিশেষ করে বৃদ্ধ বা অসুস্থ ব্যক্তিদের সেবা করার ছবি তুলে পাঠান। যেখানে ৬৮ জন আলোকচত্রী প্রায় ৫০০ ছবি জমা দেন। সেখান থেকে ১৭ জনের ছবি নির্বাচিত করা হয়। আলোচিত্র প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন সিলেটের লক্ষণ মিন্টু। পুরষ্কার হসেবে ১ লাখ টাকার পাশাপাশি তিনি পেয়েছেন সার্টিফিকেট। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছেন যথাক্রমে রাফায়েত হক খান এবং রায়হান আহমেদ। দৃকের কিউরেটর এএসএম রেজাউর রহমান, ডেইলি স্টারের প্রধান আলোকচিত্রী শেখ এনামুল হক, আলোচিত্র শিল্পী মাহমুদুর রহমান ও মনিরা মোর্শেদ মুন্নি বিচারক হিসেবে ছবি বাছাই ও নির্বাচন করেন। প্রতিদিন বিকাল ৩ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত দৃক গ্যালারিতে যে কেউ আলোচিত্রগুলো দেখতে পারবেন। প্রদর্শনীটি চলবে আগামী বুধবার পর্যন্ত।