নির্বাচনকালীন সরকার ও সেনা প্রশ্নে বিপরীত অবস্থানে ‍দুই দল

বিএনপি ও আওয়ামী লীগ

নির্বাচনকালীন সরকার ও্ প্রশাসন নিয়ে কমিশনের সংলাপে বিপরীতমুখি প্রস্তাব দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি দল বিএনপি। এরইমধ্যে দুই দল তাদের সংলাপে যেসব প্রস্তাব দিয়েছে তাতে দেখা যায় মুলত ছয়টি গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে দু-দলের প্রস্তাব বিপরীত মুখি।

গত ১৫ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে বিএনপি ২০ দফা প্রস্তাব দেয় । সেখানে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকার, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে ভোটের ৯০ দিন আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া, ২০০৮ সালের আগের সীমানায় নির্বাচন, বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে মোতায়েন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার না করা এবং সরকারের সঙ্গে বিএনপি ও অন্যান্য দলের সংলাপ অনুষ্ঠানকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছে বিএনপি।

পরবর্তী নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বিএনপির ২০ দফায় মোট ৬৬টি প্রস্তাব রাখা হয়। এগুলোর মধ্যে নির্বাচনী আইন (আরপিও), নির্বাচনী আচরণবিধি, দল নিবন্ধন বিধি, পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যম নীতিমালার সংশোধনী প্রস্তাবই বেশি।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কাল বুধবার সকালে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে যেসব প্রস্তাব দিয়েছে তার মধ্যে মোট ১১ দফা প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। সেখানে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যা বলা হয়েছে, তা বিএনপির এই ছয় প্রস্তাবের বিপরীতমুখি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় বর্তমান ক্ষমতাসীনেরাই নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের ভূমিকায় থাকবে। এই সরকারের প্রধান থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভোটের সময় সংসদ বলবৎ থাকবে। এই সম্পর্কে আওয়ামী লীগের ১১ দফায় কোন কিছু উল্লেখ নেই।

তবে শেষ তিন মাসে সংসদের কোনো অধিবেশন বসবে না। বর্তমান সংসদীয় আসনের সীমানায় পরিবর্তন প্রয়োজন নেই বলেই মনে করেন সরকারি দল। আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলে এবং কমিশন একান্ত প্রয়োজন মনে করলে কিছু পরিবর্তন আনতে পারে। ই-ভোটিং করতে পারলে ভালো হবে বলে মনে করে সরকারি দল। তবে আগামী নির্বাচনের আগে তিন লাখের বেশি ইভিএম যন্ত্র তৈরি করা সম্ভব না হলে ‘টোকেন’ হিসেবে কিছু আসনে তা করার প্রস্তাব দেয় দলটি। সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় না আনা এবং এই বাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে নয় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ব্যবহার করার সুপারিশ করে দলটি।

নির্বাচনকালীন সরকার

রোববার বিএনপির প্রস্তাবে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি ‘সহায়ক সরকার। এর অধীনে নির্বাচন করতে হবে, যা তাদের পুরনো দাবি। বাংলাদেশে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদ নির্বাচন হয়েছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।

আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়ম চালু করে। আর ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ ওই নিয়ম বাতিল করার পর থেকে বিএনপি তা পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করায় বিএনপি এখন সংসদের বাইরে।

নির্বাচন কোন নিয়মে হবে তা নির্ধারিত হয় সংবিধানের মাধ্যমে, নির্বাচন কমিশনের সেখানে করার কিছু নেই। তারপরও রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান ইসির কাছেই তুলে ধরছে। আওয়ামী লীগের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংবিধানে যেভাবে বলা আছে, অর্থাৎ ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচন হবে। সে কথাই তারা ইসির সঙ্গে সংলাপে স্পষ্ট ভাষায় সেই কথাটিই বলেছেন।

সীমানা পুননির্ধারণ প্রশ্নে

সংলাপে বিএনপি দাবি করেছে, ২০০৮ সালের আগে নির্বাচনী আসন সীমানা যে বিন্যাসে ছিল, তা পুনর্বহাল করতে হবে। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে প্রস্তাব দিয়েছে, দশম সংসদের আসন সীমানাই বহাল রাখার ।

২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আসন সীমানায় কিছুটা পরিবর্তন এনে ২০১২ সালে বর্তমান সীমানা নির্ধারণ করে ইসি। ওই সীমানা অনুযায়ীই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়টি আদমশুমারির সঙ্গে সম্পর্কিত। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আর কোনো আদমশুমারি হচ্ছে না। এই অল্প সময়ের মধ্যে কোনোভাবেই সীমানা পুনর্নির্ধারণ সম্ভব নয়। তাই আগামী নির্বাচনে আমরা দশম সংসদীয় আসনের সীমানা বহাল রাখার পক্ষে মত দেব।

ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন

শুরু থেকেই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) বিরোধিতা করে আসা বিএনপি ইসির সঙ্গে সংলাপেও একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের উদ্যোগের বিরোধিতা করেছে। দলটির দাবি, পৃথিবীর যেসব দেশে ইভিএমে ভোট হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোতেই কারচুপি ও জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর তাদের ১১ প্রস্তাবের মধ্যে ইভিএমে ভোট করার সুপারিশও করেছে। পুরো না হলেও কিছু আসনে অন্তত ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নির্বাচনী সংলাপের আগে আওয়ামী লীগের যৌথ সভায় ইভিএম এর পক্ষে কথা বলেছেন।

সেনা মোতায়েন আগামী জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে ভোটের মাঠে নামানোর প্রস্তাব ইসিতে দিয়েছে বিএনপি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়ন থেকে বিরত থাকার প্রস্তাব দেবে তারা। আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনী ব্যবহার না করা পক্ষ আওয়ামী লীগ । যদি প্রয়োজন হয়ে তাহলে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তাব্ সরকারি দলের।

মিলের জায়গা

বিএনপির ২০ দফা প্রস্তাবের মধ্যে এখনই সব রাজনৈতিক দলকে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের সুযোগ দেওয়া, ব্যালট পেপারের নিরাপত্তায় সেখানে কমিশনের লোগোর জলছাপ দেওয়া, নির্বাচনী আইন ও বিধি–বিধানের সংস্কার, ভোটের এক বছর আগে কোনো দলকে নিবন্ধন না দেওয়া, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের নির্বাচনী দায়িত্ব অগ্রাধিকার দেওয়া, প্রশাসনের ‘দলকানা’দের ভোটে দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার মতো বিষয়গুলোতে আওয়ামী লীগের মিল রয়েয়েছে বিএনপির।

‘রাজনৈতিক সংকট’ নিরসনে সরকারের সঙ্গে বিএনপিসহ অন্যান্য দলের বৈঠকের বিষয়টিতে ধীরে চলো নীতিতে চলতে চায় সরকারি দল।