
যে দুই তারকার পাযের স্বপ্ন স্পর্শে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের সেমির চৌকাঠ পেরিয়ে ফাইনালে পা রাখলো ক্রোয়েশিয়া, সেই মারিও মানজুকিচ আর ইভান পেরিসিচকেই কি-না নিজ দলের স্বপ্ন-হন্তারক বানিয়ে দিল বিশ্বকাপ ফাইনাল? একজনের আত্মঘাতী গোল আর অন্যজনের ডি-বক্সের ভেতরের হ্যান্ডবল -দুটো ভুলেই কি কপাল পুড়ল ক্রোয়াটদের? আসলে তা না।
ক্রোয়েশিয়া কেবল দুর্ভাগ্যে হারেনি। হেরেছে ফরাসিদের অদম্য গতির কাছে; ফরাসিদের অভিজ্ঞতার কাছে। হেরেছে কিলিয়ান এমবাপ্পে, পল পগবা, আন্তোনিও গ্রিজম্যান নামের ‘নব্য ফরাসি বিপ্লবের’ নায়কদের কাছে। আর এই নায়কদের হাত ধরে ফ্রান্স এখন বিশ্বজয়ী, ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন!
ক্রোয়েশিয়াকে ৪-২ গোলে হারিয়ে এমবাপ্পেরা ফ্রান্সকে এনে দিয়েছেন বিশ্বকাপের দ্বিতীয় শিরোপা। এক যুগ আগে বিশ্বকাপে জিনেদিন জিদানের মাথা নিচু করে উঠে যাওয়ার যে গ্লানি, দুই বছর আগে ইউরোর ফাইনালে শেষ মুহূর্তের গোলে হতভম্ব হয়ে যাওয়ার যে যন্ত্রণা, তার থেকে যেন মুক্তি মিলল রাশিয়ার মস্কোয়। তাও এমন এক দিনে, যার ঠিক আগের দিনটাতেই ছিল ফ্রান্সের জাতীয় দিবস, ফরাসি বিপ্লবের স্মৃতিবাহী বাস্তিল দুর্গ পতন দিবস।
ফ্রান্সের দ্বিতীয় শিরোপা উৎসবের রাতটিতে মডরিচ-রাকিটিচদের হয়তো ‘খুব কাছে, তবু কত দূরে’র আক্ষেপ নিয়েই ফিরতে হয়েছে। তবে ইউরোপের প্লে-অফ থেকে উঠে আসা একটি দল শিরোপা লড়াইয়ের মঞ্চে চলে এসেই তো অর্জনের খাতায় সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিটা পেয়ে গেছে। যে কারণে ক্রোয়েশিয়া তাই দেশে ফিরছে মাথা উঁচু করেই।
ফিফা র্যাংকিংয়ের সাত নম্বরধারী ফ্রান্সের সঙ্গে গতকাল শিরোপা নির্ধারণী লড়াইয়েও তো তাল মিলিয়ে লড়েছে ক্রোয়াটরা। দুই দফা পিছিয়ে যাওয়ার পরও লড়ে গেছে দাঁতে দাঁত কামড়ে। শুরুর দুর্ভাগ্য আর ফরাসি তারুণ্যের গতিই শেষ পর্যন্ত পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।। আগামীর তারকা হিসেবে পরিগণিত হয়ে যাওয়া এমবাপ্পে, চার বছর আগের ব্রাজিল আসরের সেরা উদীয়মান পগবা আর অভিজ্ঞ গ্রিজম্যানে ভর করে ফ্রান্সই যে এগিয়ে ছিল ম্যাচের আগে।
ফরাসি রূপকথা লেখা এই তরুণদের সঙ্গে ফ্রান্সের মূল্যবান এক রসদ হয়ে থেকেছেন দিদিয়ের দেশম। বিশ বছর আগে দেশের মাটিতে হওয়া বিশ্বকাপে ফ্রান্সের শিরোপা উঠেছিল অধিনায়ক দেশমের হাতে। দুই দশক পর সেই দেশম বিশ্বজয়ী এবার কোচ হয়ে। বিশ্বকাপ ফুটবলের একুশ আসরের ইতিহাসে খেলোয়াড়-কোচ হিসেবে বিশ্বকাপজয়ের কৃতিত্বে এটি মাত্র তৃতীয় ঘটনা। দেশম ঢুকে গেলেন মারিও জাগালো ও ফ্রেঞ্চ বেকেনবাওয়ারদের দলে।
গোলের হিসেবে বড় ব্যবধানে এগিয়ে থাকলেও রোববার রাতের ফাইনালে খেলায় এগিয়ে ছিল ক্রোয়েশিয়াই। ফ্রান্সের ৬ শটের বিপরীতে সর্বোচ্চ ১৩ শট ছিল পূর্ব ইউরোপের দেশটিরই। কিন্তু পাওয়া সুযোগ কাজে লাগিয়ে আর দ্বিতীয়ার্ধে গতিময় ফুটবল খেলেই শেষ হাসি ফ্রান্সের।
শুরু থেকে বল দখলে রেখে আক্রমণে এগিয়ে ছিল ক্রোয়েশিয়া। তবে ভালো কোনো সুযোগ তৈরি হয়নি। খেলার ধারার বিপরীতে এগিয়ে যায় ফ্রান্স। ১৮তম মিনিটে ডি-বক্সের অনেক বাইরে থেকে গ্রিজমানের ফ্রি-কিক হেডে বিপদমুক্ত করতে চেয়েছিলেন সেমি-ফাইনালের জয়সূচক গোলদাতা মানজুকিচ। বল তার মাথায় ছোঁয়া লেগে জালে ঢোকায় কিছুই করার ছিল না গোলরক্ষক দানিয়েল সুবাসিচের।
দশ মিনিট পর আবার এগিয়ে যায় ফ্রান্স পেনাল্টি থেকে। কর্নার থেকে ডি-বক্সে আসা বলে লেগেছিল পেরিসিচের হাতের ছোঁয়া। রেফারি মাঠের বাইরে গিয়ে ভিডিও রিপ্লে দেখে সিদ্ধান্ত দেন স্পট-কিকের। ঠাণ্ডা মাথায় টুর্নামেন্টে নিজের চতুর্থ গোলটি করেন গ্রিজমান।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই আবার সমতা ফিরতে পারতো। ইভান রাকিতিচের বাড়ানো বল ধরে আন্তে রেবিচের নেওয়া শট দুর্দান্তভাবে ঠেকান লরিস।
৫২তম মিনিটে ম্যাচে প্রথমবারের মতো জ্বলে উঠেন এমবাপে। পাল্টা আক্রমণে পগবার বাড়ানো বল ধরে দুর্দান্ত গতিতে ভিদাকে পেছনে ফেলে ডি-বক্সে ঢুকে শট নিয়েছিলেন পিএসজির এই ফরোয়ার্ড। পা দিয়ে ঠেকান সুবাসিচ।
দ্বিতীয়ার্ধেও অনেকটা খেলার ধারার বিপরীতে গোল পেয়ে যায় ফরাসিরা। ৫৯তম মিনিটে বাঁ দিক থেকে দুই ডিফেন্ডারকে ফাঁকি দিয়ে ডি-বক্সে এমবাপের বাড়ানো ক্রস ধরে গ্রিজমান বল পাঠান পেছনে থাকা পগবাকে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের এই মিডফিল্ডারের ডান পায়ের প্রথম শট ফেরে রক্ষণে। ফিরতি বলে বাঁ পায়ের শট যায় জালে।
ছয় মিনিট পর দুর্দান্ত গোলে ব্যবধান আরও বাড়ান এমবাপে। বাঁ দিক থেকে লুকা এরনঁদেজের পাসে প্রায় ২২ গজ দূর থেকে নিচু শটে করেন টুর্নামেন্টে তার চতুর্থ গোল। পেলের পর প্রথম টিনএজার হিসেবে বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল পেলেন ১৯ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড।
এরপরই লরিসের মারাত্মক ভুল। ব্যাকপাসে বল পেয়ে অযথা এগিয়ে আসা মানজুকিচকে কাটাতে চেয়েছিলেন। পারেননি, মানজুকিচের বুটের টোকায় বল চলে যায় জালে। নির্ধারিত সময় শেষের তখনও ২১ মিনিট বাকি। আশা জাগে ক্রোয়াট শিবিরে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ইতিহাস গড়া হয়নি মদ্রিচ-রাকিতিচদের।
১৯৯৮ বিশ্বকাপে নিজেদের অভিষেক আসরে সেমি-ফাইনালে ফ্রান্সের কাছে হারতে হয়েছিল তাদের; আর এবার ফাইনালে। ফরাসিদের বিপক্ষে জয়টা অধরাই রয়ে গেল ক্রোয়াটদের। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত দুই দলের দেখা হয়েছে ছয়বার। ফরাসিদের চার জয়ের সঙ্গে দুটি ড্র।
ব্রাজিলের মারিও জাগালো ও জার্মানির ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের পর খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের কীর্তি গড়লেন দেশম। ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।
দেশমকে মাথায় তুলে তাই কয়েকবার শূন্যে ছুড়লেন গ্রিজমান-পগবারা। লাল-সাদা-নীল পতাকা নিয়ে ছুটলেন মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে। ক্রোয়েশিয়ার নেতা লুকা মদ্রিচের চোখে তখন নির্লিপ্ত দৃষ্টি। সতীর্থদের বেশিরভাগের চোখে জল। কিন্তু আশ্চর্য শান্ত তাদের কোচ জ্লাতকো দালিচ। শিষ্যদের নিয়ে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে সবার হাতে হাত রেখে দিলেন প্রেরণা অথবা নিলেন নতুন কোনো শপথ।
এরপর ক্রমেই বাড়তে থাকা বৃষ্টির মধ্যে কেবল অপেক্ষা; সান্ত্বনার রূপার পদক গলায় ঝোলানোর জন্য ক্রোয়াটদের। ট্রফি উঁচিয়ে ধরার জন্য মধুর অপেক্ষা ফরাসিদের। প্রায় ছয় কেজি ওজনের সোনার ট্রফিটা হাতে পেতেই উড়ল সোনালী কনফেত্তি। বুনো উল্লাসে মেতে উঠল ফ্রান্সের তরুণরা। বৃষ্টিতে আতশবাজির ডিসপ্লে তেমন ফুটল না, কিন্তু ভেজা মাঠে আনন্দ যেন বহুগুণে বেড়ে গেল শিরোপাজয়ীদের।
টানা তিনটি বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন বিদায় নিয়েছে গ্রুপ পর্ব থেকে। তরুণ এই ফরাসি দলের সামনে চার বছর পর কাতার বিশ্বকাপে বড় সম্ভাবনার পাশাপাশি থাকল তাই চ্যালেঞ্জও।
Be the first to comment