
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ যুদ্ধের মতো আত্মহননের পথ বেছে নেবে না বলে জানালেনপররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী। শান্তিতে বিশ্বাসী বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক আলোচনা এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সংকটের সমাধান নিশ্চিত করবে বলে জানান তিনি।
রোহিঙ্গা সংকটের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ২৮টি দেশের কূটনীতিকদের ব্রিফিং শেষে সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী এসব কথা বলেন।
তিনি আরও জানান, ২/১ দিনের মধ্যেই মিয়ানমার সীমান্তবর্তী পাঁচটি দেশ বাংলাদেশ, ভারত, লাওস, থাইল্যান্ড ও চায়নার রাষ্ট্রদূতদের সংঘাতপূর্ণ উত্তর রাখাইনে পরিদর্শনে নিয়ে যাবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের মিয়ানমার সফরের তারিখ ২০ অক্টোবর থেকে ৩০ অক্টোবরের মধ্যে নির্ধারণের জন্যও বাংলাদেশ প্রস্তাব দিয়েছে। এখন উত্তরের অপেক্ষা করা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের পর পরই তিনি নিজেও মিয়ানমার সফরে যাবেন বলে জানান মাহমুদ আলী।
এদিকে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনীতিকদের সামনে রোহিঙ্গা সংকটের সর্বশেষ চিত্র তুলে ধরে বলেছেন, ‘এখনও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা বন্ধ হয়নি। ফলশ্রুতিতে রাখাইন থেকে এখনও রোহিঙ্গারা দলবেঁধে আসছে।’
তিনি কূটনীতিকদের আরও জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে তাদের সনাক্তকরণের পদ্ধতি কী হবে সে সম্পর্কেও বাংলাদেশ আরও হালনাগাদ প্রস্তাব পাঠিয়েছে মিয়ানমারের কাছে। ১৯৯২ সালের তুলনায় বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক মৌলিক পরিবর্তন আছে জানিয়ে ওই চুক্তির শর্তে বর্তমান বাস্তবতায় বেশ কিছু পরিবর্তন আসা উচিত বলেও মিয়ানমারকে জানানো হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে ব্রিফিংয়ে প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতও উপস্থিত ছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনীতিকদের জানান, গত ১০ দিনে আরও ৪০ হাজার রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে কক্সবাজারে এসেছে। আর জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী, গত ২৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত ৫ লাখ ২০ হাজার মিয়ানমারের নাগরিক বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত হয়ে প্রাণ ভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনীতিকদের বলেন, ‘এটা দুঃখজনক যে এখনও রাখাইনে নিষ্ঠুরতা বন্ধ হয়নি। এর ফলশ্রুতিতে রোহিঙ্গাদের দলবেঁধে বাংলাদেশে আসাও বন্ধ হয়নি।’
তিনি কূটনীতিকদের জানান, গত ২ অক্টোবর মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর দফতরের মন্ত্রী টিন্ট সোয়ে ঢাকা সফরে এসে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত নিতে তার সরকারের সদিচ্ছার কথা জানান। এক্ষেত্রে তিনি ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ-মিয়ানমার স্বাক্ষরিত যৌথ বিবৃতির নীতিমালা অনুসরণের কথা জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাকে জানানো হয়, বাংলাদেশ ১৯৯২ সালের যৌথ ঘোষণার নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন আনার পক্ষে। কারণ তখনকার পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতিতে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে।
বর্তমানে রাখাইনের গ্রামগুলো জ্বলছে এবং ২৫ আগস্টের পর থেকে রাখাইনে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোর ৫০ শতাংশের বেশি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে সনাক্তকরণের ক্ষেত্রে ১৯৯২ সালের নীতিমালা অনুসরণ বাস্তবসম্মত হবে না।
এ এইচ মাহমুদ আলী আরও জানান, এ জন্য বাংলাদেশ বর্তমান পরিস্থিতিতে কিভাবে মিয়ানমারের নাগরিকদের সনাক্ত করা হবে সেই প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব মিয়ানমারের মন্ত্রীর কাছে দিয়েছে। এ ব্যাপারে এখনও মিয়ানমারের কাছ থেকে উত্তর পাওয়া যায়নি। উত্তর পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে।
সংশ্নিষ্ট একটি সূত্র জানায়, মিয়ানমারের মন্ত্রীকে দেওয়া প্রস্তাবে উল্লেখ করা প্রক্রিয়া সম্পর্কে ব্রিফিংয়ে একটি দেশের কূটনীতিক জানতে চান। এর জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমান বাস্তবতায় মিয়ানমারের নাগরিকত্ব সনাক্তকরণে কাগজপত্র যাচাইয়ের সুযোগ নেই। কারণ তারা যে জ্বালিয়ে দেওয়া গ্রামগুলো থেকে যে অবস্থার মধ্যে প্রাণ ভয়ে পালিয়ে এসেছে সেখানে কোন ধরনের কাগজপত্র নিয়ে আসার সুযোগ থাকার বিষয়টি একেবারেই বাস্তবসম্মত নয়। এ কারণে বাংলাদেশ প্রস্তাব দিয়েছে যারা রাখাইনে তাদের বাড়িঘরের ঠিকানা বলতে পারবে তাদেরকেই মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে সনাক্ত করা হবে।’
কূটনীতিকদের ব্রিফিং শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘বর্তমানে টক শো এবং রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষ থেকে নানা ধরনের বালখিল্য ও অযৌক্তিক সমালোচনা করা হচ্ছে। বর্তমান সময়ে সংকট মোকাবেলায় যখন সবার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দরকার তখন অহেতুক অকারণ সমালোচনা করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান নাকি নতজানু। তারা কি যুদ্ধ করতে বলে? তাদের তো জানা উচিত যুদ্ধ করে বিশ্বের কোথাও কোন সংকটের সমাধান হয়নি। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ শান্তির নীতিতে বিশ্বাস করে, যুদ্ধের নীতিতে নয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শান্তির পথেই সমাধানের কথা বলেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও তার নির্দেশনা অনুসারেই যথাযথ কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যুদ্ধ মানে আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া। বাংলাদেশ সেই পথ বেছে নেবে না। বাংলাদেশ দ্বিপক্ষিক ও বহুপাক্ষিক আলোচনা এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সংকটের সমাধান করবে।’
তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগেও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকও করা যায়নি। এখন নিরাপত্তা পরিষদ উন্মুক্ত বিতর্ক করে রাখাইনে নিষ্ঠুরতার নিন্দা জানিয়েছে। এগুলো এমনি এমনি হয়নি।’
বাংলাদেশ সঠিক পথেই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারে যাচ্ছেন। তিনি ফিরে আসলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনিও মিয়ানমার সফরে যাবেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে কী আলোচনা হবে জানতে চাইলে মাহমুদ আলী বলেন, সেখানে যৌথ সীমান্ত নিরাপত্তা বিষয়ে আলোচনা হবে এবং এ সংক্রান্ত দুটি সমঝোতা স্মারক সই হবে।
গত ২ অক্টোবর যখন মিয়ানমারের মন্ত্রী আসেন তখন তাকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারত সফলভাবে সীমান্ত নিরাপত্তায় সমস্যা দূর করতে সমর্থ হয়েছে। তাহলে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে মাত্র ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত নিয়ে সমস্যা দূর কেন করা যাবে না?
তিনি আরও জানান, এর আগে বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা থেকে মিয়ানমারের নাগরিক দুজন বিদ্রোহীকে ধরে হস্তান্তর করেছে। অতএব সীমান্ত নিরাপত্তা রক্ষা ও সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের সদিচ্ছা নিয়ে সংশয়ের কিছুই নেই। ওই সময়ই যৌথ সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সে আমন্ত্রণেই এ সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘নিষ্ঠুরতা বন্ধে মিয়ানমারের প্রতি আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী পাঁচটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের উত্তর রাখাইনে সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতও ওই সফরে থাকবেন।’
এর আগেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে কয়েক দফায় কূটনীতিকদের ব্রিফিং করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপারে বিশ্বের মনোযোগ ধরে রাখা সম্পর্কিত প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টার মন্তব্য সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোন জবাব দেননি।