এবার কী তাহলে অঘটনের বিশ্বকাপ?

বিশ্বকাপে যাদের ভাবা হচ্ছে টপ ফেবারিট

ব্রাজিল, জার্মানি, আর্জেন্টিনার আর স্পেন, এই চারটি দলকেই ভাবা হচ্চিল এবারের বিশ্বকাপের বড় দল। হিসেবটাও যে একেবারে ভুল তা নয়। বিশেষ করে গত কয়েক দশকের খেলার সমীকরণ কিন্তু তাই বলে। কিন্তু এবোরের বিশ্বকাপ শুরুর পর সেই হিসেব যেন এখনো মিলছেনা। চারটি বড় দলের সেকউ প্রথম ম্যাচে জয় উদযাপনের সুযোগ পায়নি।

হতাশ এসব দলগুলোর সমর্থক কোটি ভক্ত। প্রবল প্রতিপক্ষও জয়বঞ্চিত হয়েছে বলে হতাশার ক্ষতে প্রলেপ আছে। তবে সমর্থক ছাপিয়ে দৃষ্টি যদি মাঠেই রাখা হয়, তবে চোখে পড়বে হতাশা আর আক্ষেপ-আফসোসের মুখগুলোই। ফেভারিট তকমা পাওয়া দলগুলোর লড়াকু মুখগুলো তো আর সমর্থকের চোখ দিয়ে দেখবেন না?

শিরোপার দাবিদার দলগুলোকে এমন চিন্তায় পড়ে যেতে হয়েছে চমকে যাওয়া চারটি ম্যাচের কারণে। রাশিয়া বিশ্বকাপের প্রথম চার দিনে ব্রাজিল, জার্মানি, আর্জেন্টিনা, স্পেন- সব সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়নকেই মাঠ ছাড়তে হয়েছে দুটি-তিনটি করে পয়েন্ট খুইয়ে। এর মধ্যে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন জার্মানিই পিছিয়েছে বেশি। মেক্সিকোর কাছে ০-১-এ হেরেছে জোয়াকিম লোর দল। ব্রাজিল আটকে গেছে সুইজারল্যান্ডের কাছে, এগিয়ে গিয়েও ড্র করেছে ১-১-এ। একই স্কোরলাইনে আর্জেন্টিনা থমকেছে পুঁচকে আইসল্যান্ডের কাছে। আর ছয় গোলের ম্যাচে স্পেন ড্র করেছে পর্তুগালের সঙ্গে।

ফেভারিট দলগুলোর এই বড়সড় ধাক্কায় শুরু থেকেই পাল্টে যেতে শুরু করেছে বিশ্বকাপের সমীকরণ। গ্রুপ পর্বের বাকি ম্যাচগুলোয় ফেভারিট এই দলগুলোর পারফরম্যান্সে নির্ভর করছে বাকি গতিপথ।

রোববার পর্যন্ত হওয়া প্রথম ছয় গ্রুপের খেলায় প্রত্যাশিত জয় পেয়েছে কেবল ফ্রান্স। এএফসি থেকে বিশ্বকাপ নিশ্চিত করা অস্ট্রেলিয়াকে ২-১-এ হারায় ১৯৯৮-এর চ্যাম্পিয়নরা। এ ছাড়া মোহামেদ সালাহবিহীন মিসরের বিপক্ষে উরুগুয়ের ১-০-এর জয়ও ছিল প্রত্যাশিত।

ব্রাজিল

২০১০ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে স্পেনকে হারিয়ে দিয়েছিল সুইজারল্যান্ড। ফিফা র‌্যাংকিংয়ের ৬ নম্বরে থাকা দলটি এবার প্রথম ম্যাচে রুখে দিয়েছে হট ফেবারিট ব্রাজিলকে। রোববার রাতে রোস্তভে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের সঙ্গে ১-১-এ ড্র করেছে দেশটি। মূলত সুইসদের অতি রক্ষণাত্মক কৌশলই গড়ে দেয় এ ম্যাচের পার্থক্য। শুরু থেকে ছোট ছোট পাসের লাতিনীয় ধারায় আক্রমণ শানিয়ে গেছেন নেইমার-জেসুস-কুতিনহোরা। তবে প্রথম সফলতা লম্বা শটে। ২০ মিনিটের মাথায় মার্সেলোর ক্রস সুইস রক্ষণ কর্তৃক হেডে বিপদমুক্ত করার চেষ্টা করা হলে নাগালে পেয়ে যান কুতিনহো। দূরপাল্লার কোনাকুনি জোরালো শটে বল জালে জড়ান এই বার্সা মিডফিল্ডার।

গোলের পর উজ্জীবিত ব্রাজিল প্রথমার্ধের বাকি সময়ও ছিল ছন্দে। কিন্তু বিরতি থেকে ফেরার পরই কেমন যেন অমনোযোগী হয়ে যান মার্সেলো-মিরান্ডা-থিয়াগোরা। এরই এক পর্যায়ে সমতা নিয়ে আসে সুইজারল্যান্ড। জার্মান ক্লাবে হফেনহাইমে খেলা মিডফিল্ডার স্টিভেন জুবার মাত্র ছয় গজ দূরে দাঁড়িয়ে যখন হেডে গোলটি করেন, তখন তাকে পাহারা দেওয়ার জন্য আশপাশে ছিলেন না কেউই। তবে ৫০তম মিনিটে হওয়া এই গোলের পর আবারও এগিয়ে যাওয়ার একাধিক সুযোগ পেয়েছিল সেলেকাওরা। এমনকি শেষের বাঁশির আগমুহূর্তেও ছিল ব্রাজিলের আধিপত্য। তবে ৮৮ মিনিটের সময় নেইমার আর ৯০ মিনিটের সময় পাওলিনহোর হেড ঠিকমতো লক্ষ্যে থাকেনি। খানিক পর একটুর জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় মিরান্ডার ভলিও। শেষ পর্যন্ত হতাশা নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয় তিতে বাহিনীকে। ১৯৭৮ সালের পর এই প্রথম বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে জয়হীন থাকল ব্রাজিল। এর আগে সুইসদের বিপক্ষে খেলা ১৯৫০ সালের ম্যাচটি শেষ হয়েছিল অমীমাংসিত ২-২ স্কোরলাইনে।

জার্মানি

বলা হয়ে থাকে যদি বিশ্বকাপ জিততে চাও, তাহলে কখনোই বিশ্বকাপ জেতো না। কারণ, বিশ্বকাপ জিতলেই পরেরবার প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়তে হবে। এ ‘কু-ধারণা’টি গাঢ় হয়েছে বিগত তিন বিশ্বকাপের কারণে। ২০০৬ বিশ্বকাপ জেতা ইতালি ২০১০ সালে ছিটকে গিয়েছিল প্রথম পর্ব থেকে। দক্ষিণ আফ্রিকায় হওয়া ওই আসরে শিরোপা হাতে তুলেছিল স্পেন। কিন্তু ‘তিকিতাকা’ ফুটবলের দেশটি পরের বিশ্বকাপে বরণ করে ইতালির পরিণতি। ২০১৪-এর চ্যাম্পিয়ন হিসেবে সেই ‘অভিশাপ’ তাড়া করছে এবার জার্মানিকে। গ্রুপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই মেক্সিকোর কাছে হেরে গেছে চারবারের শিরোপাজয়ীরা।

এফ’ গ্রুপে জার্মানির বড় প্রতিদ্বন্দ্বীই মূলত মেক্সিকো। কখনও কোয়ার্টার পার হতে না পারলেও দলটি এবার রাশিয়ায় এসেছে ফাইনালে ওঠার লক্ষ্য নিয়ে। গ্রুপের এমন ‘বিগ ম্যাচে’ কোনো এক দলের হার অস্বাভাবিক নয়। তবে হেরে যাওয়া দলটি জার্মানি বলেই যত কথা। গত আসরে সবক’টি ম্যাচ জিতে শিরোপাজেতা দলটি মেক্সিকোর কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। তবে লং পাসে খেলে প্রতিপক্ষের গোলমুখে গোছালো আক্রমণের যে নিপুণ প্রদর্শনী দেখা গেছে অতীতে, সেটি দেখা যায়নি। থমাস মুলার, টিমো ওয়ার্নার, মেসুত ওজিলরা খাবি খেয়েছেন বারবার। তুলনায় জুলিয়ান ব্রান্ডট ও মার্কো রিউজ নামার পর ধার পাওয়া গেছে ভালো। তবে জার্মানি ছন্দে ফেরার বহু আগে প্রথমার্ধেই মেক্সিকোকে এগিয়ে দেন হেক্টর লোজানো। শুরু থেকেই কাউন্টার অ্যাটাকে মনোযোগ দেওয়া মেক্সিকো পাল্টা আক্রমণ থেকে গোলটি পায় হাভিয়ের হার্নান্দেজের অ্যাসিস্টে।

আর্জেন্টিনা

৬৪ মিনিটের মাথায় নেওয়া মেসির পেনাল্টি শটটি জাল খুঁজে পেলেই এ ম্যাচ নিয়ে বাড়তি কোনো আলোচনা হতো না। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে আসা আইসল্যান্ডের বিপক্ষে ফেভারিট ছিল আর্জেন্টিনাই। ম্যাচের ১৯তম মিনিটে সার্জিও আগুয়েরোর দারুণ এক গোলে এগিয়েও গিয়েছিল গতবারের রানার্সআপরা। কিন্তু দিনটি ছিল আসলে সাড়ে তিন লাখ জনসংখ্যার দেশ আইসল্যান্ডের। ২৩ মিনিটে ফিনবোগাসনের গোলে সমতা আনার পরই রক্ষণকে দুর্ভেদ্য বানিয়ে ফেলে ২২ নম্বর র‌্যাংকিংয়ের দেশটি। জমাট সেই রক্ষণ ম্যাচের বাকি সময় ধরে চেষ্টা করেও ভাঙতে পারেনি আর্জেন্টিনা। গোলরক্ষকের সঙ্গে ওয়ান-টু-ওয়ান লড়াইয়ে পেনাল্টিও না। যে কারণে ২২ শতাংশের বিপরীতে ৭৮ শতাংশ বল দখল আর ২০৯ পাসের বিপরীতে ৭৫২ পাস দিয়েও আর্জেন্টিনার অর্জন মাত্র ১ পয়েন্ট।

স্পেন
বর্তমান ক্লাব ফুটবলের জায়ান্ট দল স্পেন। তাদের খেলোয়ারের কমতি নেই। কিন্তু পর্তুগালের ছিলেন মাত্র একজন। তাঁর সামনে এক সময়ের বিশ্বজয়ী স্প্যানিশ ‘আর্মাডা’। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কী অনুপম দক্ষতায় একাই তাঁদের রুখে দিলেন! সেই ম্যাচের আসল স্কোরলাইন তো স্পেন ৩—৩ রোনালদো। সেটা তাঁর হ্যাটট্রিকের জন্য নয়। দলে তারকা বলতে তিনি একাই। কিন্তু সেদিন গোলের সঙ্গে আক্রমণ কিংবা রক্ষণে রোনালদো একাই হয়ে উঠেছিলেন ‘দু-ধারি তলোয়ার’। আর তাতেই কাটা পড়েছে স্প্যানিশ তারকা সম্ভার। নিজেদের চেয়ে সব দিক থেকেই শক্তিশালী একটা দলকে যে একাই রুখে দেওয়া যায়, সেটা এক সময় বাংলা সিনেমার পর মনে করিয়ে দিলেন রোনালদো।

Be the first to comment

Leave a Reply