
রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর ‘জাতিগত নিধনে’র বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ ও প্রতিবাদকে ক্রমাগত উপেক্ষা করে চলেছে মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনার দিনও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হামলা ও নির্যাতন অব্যাহত ছিল রাখাইনে।
বৃহস্পতিবারও রাখাইনে বিদেশি কূটনীতিকদের সফর শেষ মুহূর্তে বাতিল করে মিয়ানমার। উত্তর রাখাইনের মংডুতে রোহিঙ্গাদের এলাকা ছাড়ার নির্দেশও বহাল রেখেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা এই তথ্য জানিয়ে বলেছে, গত মঙ্গলবার থেকে সেনাবাহিনী তাদের এলাকাছাড়া করছে। গত ২৫ আগস্ট থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে।
রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবজ্ঞা করলেও দেশটির রাশ টেনে ধরতে নানামুখী তৎপরতা অব্যাহত আছে। এ প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার সফরের পর বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে আসেন যুক্তরাজ্যের এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড। তিনি নেপিডোতে মিয়ানমারে স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির সঙ্গে এবং ঢাকায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নতুন করে সহিংসতা শুরুর পর পশ্চিমা কোনো দেশের প্রতিনিধি হিসেবে মার্ক ফিল্ডই প্রথম ওই রাজ্য ঘুরে এলেন। মার্ক ফিল্ড রাখাইনের সিত্তেতে গেলেও সহিংসতাকবলিত মংডু, বুথিডং কিংবা রাথিডংয়ে যেতে পারেননি।
মিয়ানমারের ওপর শক্ত পদক্ষেপ নিতে সতর্ক থাকার কথা বলেছেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, সু চির সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে কূটনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধান করা উচিত। কারণ, পরিস্থিতি মোকাবিলায় সু চি ব্যর্থ হলে সেনাবাহিনী ‘সর্বময় ক্ষমতার’ অধিকারী হবে।
রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে, বিশেষ করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে শুরু থেকেই উচ্চকণ্ঠ রয়েছে যুক্তরাজ্য। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। তবে এই মুহূর্তে যুক্তরাজ্য সু চির ওপর বেশি চাপ দেওয়ার পক্ষে নয়। মার্ক ফিল্ড বলেন, ‘আমাদের অং সান সু চির সীমাবদ্ধতাও বুঝতে হবে। সেনাবাহিনীর ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশটির সংবিধান অনুযায়ী এখনো সেনাবাহিনী যথেষ্ট শক্তিশালী। সু চি আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপের মধ্যে একটি “সঠিক পথ” বের করার চেষ্টা করছেন।’
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানান, সু চি সব শরণার্থীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে মার্ক ফিল্ড বলেন, ‘আমি নিজের চোখে ভয়াবহ অবস্থা দেখেছি। আমরা এখন যা করতে পারি তা হলো আমাদের বন্ধুদের দিয়ে যত সম্ভব চাপ প্রয়োগ। এই সংকট সমাধানে পর্দার অন্তরালে অনেক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলছে এবং এটা এখন আর একটি আঞ্চলিক ইস্যু নয়। এই পর্যায়ে আমরা সব ধরনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাব।’
তিনি আভাস দিয়েছেন, সু চি ব্যর্থ হলে মিয়ানমারের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব সেনাবাহিনীর হাতে চলে যাবে। তাতে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।
মার্ক ফিল্ড জানান, সু চির সঙ্গে বৈঠকে সংকট নিরসনে তিনি জরুরি পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। রাখাইন সমস্যার সমাধানের জন্য অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ, রাজ্যটিতে মানবিক ত্রাণকর্মীদের যাওয়ার অনুমতি দেওয়া এবং আনান কমিশনের সুপারিশ দ্রুত ও পুরোপুরি বাস্তবায়ন চায় যুক্তরাজ্য। সমস্যা সমাধানে এই তিন বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্তরাজ্য চাপ অব্যাহত রাখবে।
মার্ক ফিল্ড জানান, যুক্তরাজ্যও চায় রোহিঙ্গা শরণার্থীরা মিয়ানমারে ফিরে যাক। অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত শিবিরে নয়, তারা বাড়িতেই ফিরে যাক।
নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে মার্ক ফিল্ড বলেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদে পদক্ষেপ নিতে হলে একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হয়। এই প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ। তবে এ জন্য ধৈর্য ধরতে হবে। আমি মনে করি, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীকে সু চির আমন্ত্রণ
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সঙ্গে টানাপোড়েনের মধ্যেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করে চলেছে মিয়ানমার। দেশটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বোঝাতে চাইছে বাংলাদেশের সঙ্গে সমস্যা সমাধানে দ্বিপক্ষীয়ভাবে আলোচনা চলছে। আগামী ২ অক্টোবর বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসছেন অং সান সু চির দপ্তরের মন্ত্রী কিউ তিন্ত শোয়ে। আর নভেম্বরে নেপিডোতে অনুষ্ঠেয় আসেমের আলোচনায় যোগ দিতে অং সান সু চি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। গত বুধবার সু চির ওই আমন্ত্রণ ঢাকায় পৌঁছেছে।
অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার চায় অ্যামনেস্টি
বেসামরিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ‘ব্যাপকভিত্তিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা’সহ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে বলেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা নিপীড়ন নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনাকে সামনে রেখে লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠনটি গত বুধবার গভীর রাতে ওয়েবসাইটে প্রচারিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই আহ্বান জানায়।
অ্যামনেস্টির পরিচালক তিরানা হাসান বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের জোর করে বের করে দিচ্ছে এবং তাদের হত্যা করছে। মানবতাবিরোধী এ অপরাধ সুস্পষ্টভাবে জাতিগত নিধনের শামিল। মিয়ানমারের কাছে সব ধরনের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ বন্ধ করার লক্ষ্যে দেশটির ওপর এখনই একটি ‘ব্যাপকভিত্তিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা’ আরোপ করতে হবে। এ ছাড়া মিয়ানমারের কাছে পরোক্ষভাবে যাতে কোনো অস্ত্রের সরবরাহ না ঘটে এবং দেশটির সেনাবাহিনী যেন কোনো ধরনের সামরিক প্রশিক্ষণ না পায়, সেদিকেও জাতিসংঘকে নজর দেওয়ার তাগিদ দিয়েছে অ্যামনেস্টি।