১৯৯২ সালের চুক্তির আওতায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন চায় যুক্তরাষ্ট্র

রোহিঙ্গারা ফিরতে চায় নিজ ভূমিতে

কোনো শর্ত না দিয়ে ১৯৯২ সালের চুক্তির আওতায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের প্রতি আহবান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও পুরনো ওই চুক্তির আওতায় বর্তমানে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আপত্তি জানিয়ে আসছে বাংলদেশে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংকে ফোন করে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করে এই আহবান জানান।

পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র হিদার নাউয়ার্ট এক বিবৃতিতে বলেন, রাখাইনে সহিংসতা বন্ধে মিয়ানমার সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন টিলারসন।

“এই সঙ্কটের কারণে বাস্তুচূত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা যাতে নিরাপদে তাদের ঘরে ফিরতে পারে, সেজন্য নতুন কোনো শর্ত না দিয়ে ১৯৯২ সালের বাংলাদেশ-মিয়ানমার যৌথ বিবৃতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।”

রেক্স টিলারসন

মিয়ানমার সরকার আগেই জানিয়েছে, ১৯৯২ সালের প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় রোহিঙ্গাদের তারা ফেরাতে রাজি।

কিন্তু ওই চুক্তি এখন আর ‘বাস্তবসম্মত নয়’ জানিয়ে একটি নতুন প্রস্তাব দিয়ে মিয়ানমারের জবাবের অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশ।
রাখাইনে কয়েকশ বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসবাসের ইতিহাস থাকলেও ১৯৮২ সালে আইন করে তাদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাই রোহিঙ্গাদের বর্ণনা করে আসছেন ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ ও ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে।
সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে পালিয়ে আসা চার লাখের মত রোহিঙ্গা গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে। আর গত ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নতুন করে দমন অভিযান শুরুর পর ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে।

বেশ কিছুদিন কূটনৈতিক আলোচনার পর ১৯৯২ সালে মিয়ানমারের সামরিক সরকার শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি প্রত্যাবাসন চুক্তি করে, যেখানে রোহিঙ্গাদের ‘মিয়ানমার সমাজের সদস্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

ওই চুক্তির আওতায় মিয়ানমার সে সময় দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন রোহিঙ্গাকে দেশে ফিরিয়ে নেয়। চুক্তি নির্ধারিত যাচাই প্রক্রিয়ায় আরও ২৪১৫ জন শরণার্থীকে সে সময় মিয়ানমার থেকে আসা বলে চিহ্নিত করা হলেও মিয়ানমার তাদের আর ফিরিয়ে নেয়নি।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনার মধ্যে গত ১৯ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে সু চি বলেন, ১৯৯২ সালে করা প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় ‘যাচাইয়ের মাধ্যমে’ বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রাখাইনের মুসলমানদের ফিরিয়ে নিতে তার দেশ প্রস্তুত।
এর ধারাবাহিকতায় সু চির দপ্তরের মন্ত্রী কিয়া তিন্ত সোয়ে অক্টোবরের শুরুতে ঢাকায় এলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে দুই দেশ একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের বিষয়ে সম্মত হয়।

ওই বৈঠকেই ১৯৯২ সালের যৌথ বিবৃতির বদলে নতুন একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এগিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ। মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলকে চুক্তির একটি খসড়াও হস্তান্তর করা হয়।

গত ৯ অক্টোবর ঢাকায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, যে প্রেক্ষাপটে ১৯৯২ সালের চুক্তির নীতিমালা ও যাচাইয়ের প্রক্রিয়াগুলো ঠিক করা হয়েছিল, বর্তমান পরিস্থিতি তার তুলনায় অনেকটাই আলাদা। সুতরাং ওই চুক্তি অনুসারে এবার রোহিঙ্গাদের পরিচয় শনাক্ত করার প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নয়।

এ কারণে নতুন ওই দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রস্তাব করা হলেও মিয়ানমারের জবাব এখনও বাংলাদেশ পায়নি।

বাংলাদেশ বরাবরই বলে আসছে, মানবিক কারণে আপাতত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হলেও তাদের অবশ্যই মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে হবে। এ সমস্যার পেছনে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা নেই; সমস্যার সৃষ্টি ও কেন্দ্রবিন্দু মিয়ানমারে, সমাধানও সেখানে নিহিত।

বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল চলতি সপ্তাহে মিয়ানমারে গিয়ে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করেন। দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে এ সমস্যার সমাধানে ১০টি বিষয়ে একমত্যে পৌঁছায় দুই দেশ।

অং সান সু চির সাথে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বৈঠক

সীমান্ত দিয়ে নতুন করে মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ বন্ধ করা; এরই মধ্যে যারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের যত দ্রুত সম্ভব ফিরিয়ে নেওয়া এবং তাদের পুনর্বাসনের জন্য রাখাইনের পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক করার কথা বলা হয় সেখানে।
মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ দেশটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের তাগিদ দেওয়া হয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।
আর গত বুধবার মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতা সু চির সঙ্গে দেখা করে আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল তাকে স্পষ্ট করেই বলেন, বাংলাদেশ কোনো সন্ত্রাসীকে প্রশ্রয় দেবে না। কিন্তু অনুপ্রবেশকারীদের দ্রুত ফিরিয়ে না নিলে তাদের অনেকেই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়তে পারে। তখন পরিস্থিতি বাংলাদেশ বা মিয়ানমার- কারও অনুকূলে থাকবে না।